অন্তর্জালের ঝঞ্ঝাটে না গিয়ে কাগজেকলমে পত্রিকা করার একটা ভাল দিক হল দিনে ক’খানা লেখায় ক’টা ‘হিট’ হল তা চেক করার কোনো দায় থাকেনা। একবার বই হাতচালান হয়ে গেলেই হল। ক’জন পাঠক কোন লেখাটা কতবার পড়েছেন সেসব খুঁটিয়ে জানার দায়িত্ববোধ বা স্পৃহা সম্পাদকের থাকুক ছাই না থাকুক, উপায় থাকেনা। জনে জনে ধরে সার্ভে নিতে গেলে অবশ্য অন্য কথা…
আপাতত কথা হচ্ছে এই, যে আয়নানগর ব্লগের যে ক্যাটেগরিতে সবচাইতে কম ‘হিট’ পড়ে সেটা হল আমাদের অনলাইন আর্কাইভ। পুরনো ছোট পত্রিকা – যা তিন-দশ-পনের-পঁচিশ বছর আগে বেরিয়ে এখনও পুরোদমে চলছে, বা হয়তো মরে-হেজে গেছে, হয়তো পাতিরাম ধ্যানবিন্দু সমস্ত আড়ত খুঁজেও তাদের আর পাওয়া যাবেনা। ধরুন আপনি বাংলা সাহিত্যপ্রেমী। এখন কেউ যদি হঠাৎ এক শনিবারের সকালে বিনি মাগনায়, সোজা আপনার দোরগোড়ায়, তেমনই এক নাম না-জানা বা জানা, পড়া বা না-পড়া পত্রিকার অবস্কিওর একটি সংখ্যা এনে হাজির করে, একবারটি কি নেড়েচেড়ে (পড়ুন, স্ক্রোল করে) দেখারও সাধ জাগেনা? আমাদের তো জাগে! অন্তত ল্যাপটপে ডাউনলোডটি করে রেখে দিই ঠিক। পড়ে ওঠা সবসময় তক্ষুনি-তক্ষুনি নিয়ম করে হয়ে ওঠেনা বটে, তবে হঠাৎ করে আবার হয়েও যায় – প্রয়োজনে, সময় কাটাতে – যেমন করে পৃথিবীর বেশিরভাগ বই পড়া হয় আর কি। আবার বেশিরভাগ সময়ই সফ্ট কপিটি উল্টেপাল্টে দেখার পরে উৎসাহিত হয়ে বইটাই কিনে ফেলি। কিন্তু মূল কথা হল, সাধটুকু থাকে।
হয়তো এ বাবদে জয় গোস্বামীই ঠিক কথা বলেছেন – যেদিন লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি আর থাকবেনা সেদিনই তার প্রয়োজন বোঝা যাবে।
যাই হোক, তেমন এক সাধের জায়গা থেকেই আমাদের আয়নানগরের জন্ম। আর সেই সাধের জায়গা থেকেই, অন্যান্য সংখ্যার আয়নানগর-আর্কাইভের থেকে আমাদের এবারের সংখ্যার আর্কাইভের তফাৎ এই, যে ‘হিটে’র তোয়াক্কা না রেখে এবারে আমরা একটির বদলে ছয়টি লিটল ম্যাগাজিন ও লিটল পাবলিকেশনকে (যাঁদের মধ্যে অধিকাংশেরই নাম কোন একজিস্টিং লিটল ম্যাগাজিনের লিস্টে পাওয়া যাবেনা। কি অনায়াসে এঁরা মার্কেটনীতিকে কলা দেখিয়ে চলেছেন – কেউ নিঃশব্দে, কেউ বা সগর্জনে!) – আমাদের স্বল্প পরিসরে ও ততোধিক স্বল্প কর্মক্ষমতাসীমার ভিতরে যেটুকু সম্ভব – তুলে ধরার চেষ্টা করছি। কিন্তু যত না তুলে ধরতে পারছি, না পারছি তার চেয়ে এত অস্বস্তিকর রকমের বেশি…!
আসলে অনলাইন আর্কাইভ করে এক মস্ত বাঘ মেরেছি – এই স্ট্যান্ড পয়েন্ট থেকে আমাদের যে একটা গত বইমেলা-ফেরতা ব্যাপক বিচ্যুতি ঘটল, সেটা নিয়ে প্রতিমুহূর্তে সংকটাপন্ন হচ্ছি। সাহিত্য কি, পত্রিকা কি, লিটল-বিগ বলতে আমরা কি বুঝি – এমনকি লেখা নির্বাচনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়ার যোগ্যতাবিষয়ক নানা এক্জিসটেনশিয়াল প্রশ্ন উঠে আসছে। ভরত যে কোন সাধে জড়ভরত হয়েছিলেন তার কতকটা উপলব্ধি করতে পারছি, ব্রহ্মজ্ঞানটুকু লাভ করতে যা বাকি। আজ যদি কেউ আঙুল তুলে প্রশ্ন করেন, এই গল্পটি কেন, ঐটি কেন নয়, কেন এই কবি আর উনি নন, এই পত্রিকা কেন, কেন নয় হাজার হাজার আরও যে পত্রিকা বাজারে-বন্দরে ডুবছে-ভাসছে তার অন্য কোনো একটি – আমাদের কাছে তেমন চমৎকার কোনো উত্তর নেই। খুঁটে খুঁটে যেমন পাচ্ছি-বুঝছি, তেমনটিই করছি – এই অব্দি। সুবিমল মিশ্র বারো সালে ‘উল্টো দূরবীন’কে দেওয়া ইন্টার্ভিউতে বলেছিলেন –
“লিটল ম্যাগাজিন ঘাঁটতে ঘাঁটতে এমন লেখা হঠাৎ হঠাৎ করে পেয়ে যাই বইকি! চমকে ওঠার মতো লেখা। ঘাবড়ে দেবার মতো। মূলত তরুণদের। […] যা কিছু পেয়েছি, চমকে দেবার মতো, লিটলম্যাগাজিনেই। বিগম্যাগে, তথাকথিত সাহিত্য-সংস্কৃতির মাতব্বর পাক্ষিক কাগজে তো…”
শূন্যস্থানটুকু সুবিমল মিশ্র – এই নামের সাথে পরিচিত পাঠকরা পূরণ করে নিতে পারবেন। কিন্তু ঐ হঠাৎ চমকে যাওয়ার আশাতেই আমাদেরও লিটল ম্যাগ আর্কাইভাল যাত্রা।