শ্রীপর্ণা ভাদুড়ি
শ্রীপর্ণা পরিবেশ বিজ্ঞানের প্রাক্তন ছাত্রী, লিঙ্গবৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী এবং ‘চিত্রাঙ্গদা: একটি লিঙ্গবৈষম্য বিরোধী উদ্যোগ’-এর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।
“প্রতিবাদ ও সচেতনতা দারুণ জিনিস, কিন্তু অতি উৎসাহের চোটে ‘জিভ কাটো লজ্জায়’–এর ট্রেন এমন হুড়মুড় ছাড়লে, অবিলম্বে ‘মুখ ঢেকে যায় কারেকশনে’–র স্টেশনে ঢুকে পড়বে।
এই ঘোটালায় অ–পণ্ডিতদের একটা উপায় আছে, কথাবার্তা প্রায় বন্ধ করে দেওয়া। বোবার শত্রু নেই, ব্লগ–বাইলাইনের ঝাড়ও নেই। সলমন এ জন্যেই বলেছেন, এ বার থেকে কম বলব। আর এক হয়, সেলোটেপ দিয়ে মুখ এঁটে রাখা। কিন্তু নারীবাদীরা সব্বাই পহলাজ নিহলানির মতো দেখতে হয়ে গেলে, হাসির তোড়ে সেই সেলোটেপ ছিঁড়ে না যায়!” —চন্দ্রিল ভট্টাচার্য
দেখেছিল ঘুঘু/ আহা পড়ে গেছে ফাঁদে…
গত ৩০শে জুন সক্কাল সক্কাল অত্যন্ত আনন্দের সাথে বিখ্যাত দৈনিকের সম্পাদকীয়তে চন্দ্রিল ভট্টাচার্য, সলমন খানের ধর্ষণ সংক্রান্ত বক্তব্যের সারমর্ম উদ্ধার করে “স্বতঃস্ফূর্তি”র সাথে ভাষার এক বাজারীয় পরিবেশন করলেন যার সারবক্তব্য ছিল সলমন নাহয় ‘বোকার মতো’ একটা প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়েই ফেলেছেন কিন্তু তার জন্য এই যে সব্বাই (পড়ুন নারীবাদীরা) ‘ভয়ানক ইন্সেন্সিটিভ’ বলে চোখ কপালে তুলেছেন তা তিলকে তাল করা বই অন্য কিছু নয়। কারণ আমারা প্রত্যেকদিন নিজের ভাব প্রকাশ করতে গিয়ে এমন সব কথা বা বলা ভালো উপমা খুব অনায়াসেই ব্যবহার করে থাকি যা কোনো না কোনো ভাবে কোনো না কোনো মানুষের যন্ত্রণাকে ছোটো করে, অপমান করে। তাই ‘ধর্ষণ’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করার জন্য যারা ভাইজানের আসল ‘ইনটেনশন’ না বুঝেই তার ওপর রে রে করে তেড়ে গেছেন তারা “ওভার রিঅ্যাক্ট” ছাড়া অন্য কিছুই করছেন না। তিনি তার এই অকাট্য বক্তব্যকে সমর্থন করার উদ্দেশ্যে বেশ কিছু প্রচলিত শব্দের তুল্যমূল্য বিচারও করেছেন। ব্যবহারিক প্রয়োগের দিক থেকে যে শব্দবন্ধগুলির ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ প্রচলন অস্বীকার করে চন্দ্রিল বাবুর যুক্তিকে একেবারেই বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া যায় না কারণ সত্যি একথা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই যে আমাদের নিত্যনৈমত্তিক জীবনে প্রকৃত মর্মার্থ না ভেবেই আমরা এমন অনেক তুলনামূলক শব্দবন্ধ খুব সহজেই, খুব হালকা ভাবে ব্যবহার করে থাকি যেগুলো প্রত্যক্ষ হোক বা পরোক্ষভাবে, কোনো না কোনো মানুষের জীবন যন্ত্রণাকে লঘু করে দেখায়। উদাহরণ হিসাবে ধরা যেতে পারে বহুল প্রচলিত কিছু শব্দবন্ধ যেমন ‘কাজের লোকেদের’ মতো ঝগড়া করা, ‘মেথরের’ মতো নোংরা বা ‘গ্রাম্য অশিক্ষিত’দের মতো কথাবার্তা ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলতঃ চন্দ্রিল বাবুর মতো অনেক সাধারণ মানুষেরই ‘ধর্ষণ’ শব্দটির ব্যবহারিক প্রয়োগকে আলাদা করে ‘গুরুত্ব’ দেওয়া একদিক থেকে, শস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার চেষ্টা বা যৌনতার সাথে সরাসরি যুক্ত থাকার কারণে নারীবাদীদের ‘প্রগতিশীল’ মননে আঘাত লেগেছে, বলে মনে হতেই পারে।
ছোট আছো ছোট থাকো/ শস্তা সাবান মাখো
কিন্তু এখান থেকেই প্রশ্ন ওঠে এই পুঁজিবাদী পিতৃতান্ত্রিক সমাজ যেখানে প্রতিনিয়ত আমাদের সামনে ‘প্রকৃত’ জীবনযাত্রার নিত্যনতুন মানদণ্ড নির্মাণ করে যাচ্ছে সেখানে এই মানদন্ডের ঋণাত্মক অবস্থানে থাকা মানুষগুলোর জীবনকে নীচু করে দেখানো এবং সাহিত্য থেকে কথ্য ভাষায় তার যথেচ্ছ ব্যবহারের মাধ্যমে তাকে স্বাভাবিকত্বের মান্যতা দেওয়া কি আসলে এই শোষণ কাঠামোয় উপস্থিত ভাষা কেন্দ্রিক বৈষম্যের বৃহত্তর রাজনৈতিক আঙ্গিক এবং তার সাথে ওতপ্রোত ভাবে জুড়ে থাকা জনপ্রিয় গণমাধ্যমগুলির দ্বিচারিতাকেই উন্মুক্ত করে দেয় না?
বিষয়টির গভীরতাকে আরও স্পষ্টভাবে জানাবোঝার জন্য প্রথমেই আরও একবার দেখে নেওয়া দরকার দাবাং বয় ঠিক কি মন্তব্য করেছিলেন সেদিন। কুস্তিবিদের ভূমিকায় অভিনয় করার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে আমাদের প্রিয় ভাইজান বলেছেন শ্যুটিং-শেষে নিজেকে একজন ধর্ষিতা মেয়ের সমতুল্য মনে হত কারণ তিনি নাকি সোজা হয়ে হাঁটতে পর্যন্ত পারতেন না। এখন তিনি যে মোটেও ‘ধর্ষিতা’ ব্যক্তির বেদনাকে অপমান করতে চাননি বরং শ্যুটিং চলাকালীন তার উদয়াস্ত খাটুনিকেই ইঙ্গিত করে এই উপমা টেনে এনেছেন সেটা চন্দ্রিল বাবু ফলাও করে না লিখলেও বুঝতে কারোরই খুব কিছু সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই বক্তব্যটি বেশ কতগুলি সমস্যাজনক আঙ্গিক আমাদের সামনে তুলে আনে।